দুগ্ধ উৎপাদন ও বিপণন

আবহমান কাল ধরে গ্রামীণ জনপদে গাভী, ছাগল ও মহিষের দুধ মানুষের প্রাণিজ আমিষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে আসছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গবাদিপশু পালনের হার না বাড়ায় দুধ উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি হয়। পাশাপাশি দুধের চাহিদা বাড়ায় খোলা বাজারে গাভীর তরল দুধে ভেজাল মেশানোর প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। একসময় দুধের পরিমাণ বাড়াতে পানি মেশানো হলেও এখন আর তা পানিতে সীমাবদ্ধ নেই। এখন দুধে মিশে যাচ্ছে মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ নানাবিধ ক্ষতিকর রাসায়নিক ও অণুজীব। কেবল খোলা তরল দুধেই নয়, বিভিন্ন কোম্পানির বাজারজাত করা প্যাকেটজাত তরল দুধেও পাওয়া যাচ্ছে মারাত্মক ক্ষতিকর এসব রাসায়নিক এবং সহনীয় মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় নানা অণুজীব।

 

সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের স্বপ্রণোদিত এক রুল জারি করে। এ রুলের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার উচ্চ আদালতে নিরাপদ খাদ্য কর্র্তৃপক্ষের দাখিল করা প্রতিবেদনে দুধে ভেজালের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা ভয়াবহ। সারা দেশ থেকে সংগৃহীত গাভীর খোলা দুধের ৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে ৯৩ শতাংশেই বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর অণুজীব পাওয়া গেছে। অণুজৈবিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ৯৩টি নমুনাতে টিপিসি ও কলিফরম ক্ষতিকর মাত্রায় বিদ্যমান। একটি নমুনায় সালমোনেলা পাওয়া গেছে। আর মানবদেহের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা মিলেছে ১৫ শতাংশ দুধে। ১৩ শতাংশ দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি টেট্রাসাইক্লিন, ৯ শতাংশের গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি কীটনাশক এবং ৩ শতাংশে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি আফলাটক্সিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

 

একই প্রতিবেদনে বাজারে বিক্রি হওয়া প্যাকেট দুধের মোট ২১টি দেশি ও ১০টি আমদানিকৃত নমুনার মধ্যে ৬৬-৮০ শতাংশে উচ্চমাত্রায় বিভিন্ন অণুজীব, ৩০ শতাংশে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি টেট্রাসাইক্লিন, একটি নমুনায় ক্ষতিকর মাত্রার সিসা এবং বেশ কয়েকটিতে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ও এনরোফ্লোক্সাসিন পাওয়া গেছে। ১৭টি দেশি দুধের নমুনায় টিপিসি ও কলিফরম, ১৪টিতে মোল্ডস এবং আমদানি করা তরল দুধের একটি নমুনাতে কলিফরম ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া গেছে। পাশাপাশি, পশুখাদ্যের ৩০টি নমুনার মধ্যে সব কটিতেই সিফরোফ্লক্সাসিন এবং ২টিতে কীটনাশক অ্যান্ডোসালফান ক্ষতিকর মাত্রায় বিদ্যমান। ১৬টিতে ক্রোমিয়াম, ৪টিতে আফলাটক্সিন, ২২টিতে টেট্রাসাইক্লিং, ২৬টিতে এনরোফ্লক্সাসিন রয়েছে।

 

সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুধে ভেজাল ও মারাত্মক ক্ষতিকর সব উপাদান থাকার উল্লেখযোগ্য কারণ অনিরাপদ পশুখাদ্য এবং যথাযথ সংরক্ষণ ও বিপণনব্যবস্থার ত্রুটি। দেশে পর্যাপ্ত পশুখাদ্যের সরবরাহ না থাকায় এ ক্ষেত্রে আমদানি-নির্ভরতা রয়েছে। অন্যদিকে, আমদানি করা পশুখাদ্যের চড়া দামের কারণে বাজারে কমদামে ভেজাল ও ক্ষতিকারক পশুখাদ্যের সরবরাহ বেশি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে সারা দেশে প্রায় ৫৮ হাজার খামার আছে। এসব খামারের ৭০ শতাংশ খরচ হয় পশুখাদ্যের পেছনে। এ অবস্থায় শুল্কমুক্ত গোখাদ্য আমদানি এবং স্থানীয়ভাবে পশুখাদ্য উৎপাদনে প্রণোদনা দিতে পারে সরকার। অন্যদিকে, জেনেটিক্যালি বেশি দুধ দেওয়া গাভীর জাত উদ্ভাবনে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করলেও এখনই কৃষকরা তার সুফল পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় বহির্বিশ্ব থেকে বেশি দুধ দেওয়া উন্নত জাতের গরু এনে দেশীয় পদ্ধতিতে লালনপালনে খামারিদের সহায়তার উদ্যোগ সম্প্রসারিত করা জরুরি। পাশাপাশি বাজারে মানসম্মত তরল দুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিপণনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুধ সংরক্ষণ ও বিক্রির ব্যবস্থাপনায় সরকারি নজরদারি ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

 

পুষ্টিচাহিদা পূরণে প্রাণিজ আমিষ হিসেবে গাভীর দুধের কোনো বিকল্প নেই। পুষ্টিবিদেরা বলেন, প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে অন্তত ১ কাপ দুধ খাওয়া উচিত। কেবল রাজধানী ঢাকার জনগোষ্ঠী যদি দিনে ১ কাপ করে দুধ খায়, তাহলে প্রায় ১০ লাখ লিটার দুধ প্রতিদিন প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর মিলে দিনে ৫ লাখ লিটার দুধও বিক্রি হয় না। এই পরিস্থিতি থেকে একদিকে যেমন নাগরিকদের পুষ্টি চাহিদার ঘাটতির চিত্র ফুটে উঠছে, তেমনি তা দেশে দুধ উৎপাদন ও বিপণনের বিশাল বাজারের সম্ভাবনাকেও নির্দেশ করছে। সরকারের এখন একদিকে যেমন বাজারে খোলা ও প্যাকেটজাত দুধের ভেজাল বন্ধ করে নিরাপদ দুধের জোগান নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, তেমনি বিপুল সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে ভবিষ্যতমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *